বাংলা সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখানো হচ্ছে- সিনেমার ভিলেন নায়িকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করছে।
এর পরের দৃশ্য এবং কথোপকথন- আমার কাছে মনে হয়েছে তা প্রচারযোগ্য নয়। এমন দৃশ্য হরহামেশাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সংযোজন করা হয়।
বাংলাদেশে ফিল্ম ফেডারেশন করপোরেশন বা এফডিসিতে অধিকাংশ চলচ্চিত্রের শুটিং থেকে শুরু করে একেবারে শেষ মুহূর্তের কাজগুলো হয়ে থাকে। বিশাল এই চত্বরে বিভিন্ন দেয়ালে মুক্তি পেতে যাওয়া বিভিন্ন চলচ্চিত্রের পোস্টার সাজানো রয়েছে।
ক্যামেরা, লাইট, আর্টিস্ট, পরিচালক পার করছেন ব্যস্ত সময়। এর এক ফাঁকে আমার কথা হচ্ছিল ঢাকার চলচ্চিত্রের একজন নায়ক জায়েদ খানের সাথে। কথা প্রসঙ্গে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মেয়েদের যেভাবে দেখানো হয় সেটাকে তিনি কীভাবে দেখেন?
তিনি বলছিলেন “উপস্থাপন ভালো করে না করলে একজন শাবানা বা ববিতা কিভাবে সৃষ্টি হলো। আমি অনেক স্থানে শুনেছি উনাদের নামে বাচ্চাদের নামকরণ করতে। বর্তমান সময়ে মেয়েদের স্বাবলম্বী করে চরিত্র তৈরি করা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক চলচ্চিত্রের একটা সময় গেছে”।
জায়েদ খান এখন চলচ্চিত্র অঙ্গনে ১১ বছর হলো কাজ করছেন, মুক্তি পেয়েছে ৩৮টির মতো সিনেমা। অনেক চলচ্চিত্রে নায়িকার কাছে প্রেম নিবেদন করতে দেখা গেছে। অনেক সময় বন্ধুদের দল নিয়ে নায়িকার পিছু নেয়া বা বিভিন্ন মন্তব্য করা। যেটাকে অনেকেই হয়রানিমূলক মনে করেন। নায়ক হিসেবে তার এখানে কতটা ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে প্রশ্ন ছিল মি. খানের কাছে।
তিনি বলছিলেন “আপনি প্রথম সাংবাদিক যিনি এই বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। আমরা গল্পকারের গল্প অনুযায়ী চরিত্রের রুপায়ন করি যেখানে আমাদের করার তেমন কিছুই থাকে না। তবে আমি এইসব দৃশ্যকে হয়রানি হিসেবে দেখছি না। কারণ পরের সিনেই দেখানো হয় নায়ক বলছে সে যা কিছু করেছে সেটা ঐ মেয়েকে ভালোবেসে করেছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টা পজিটিভ হয়ে যাচ্ছে। কাউকে হয়রানিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে না”।
বাংলা চলচ্চিত্রের এসব দৃশ্য ধারণ বা দেখানোর পেছনে পরিচালকদের একটা যুক্তি থাকে সিনেমার গল্পের প্রয়োজন বা চরিত্রের প্রয়োজনে এসব দৃশ্য রাখা হয়।
অনেক পরিচালক মনে করেন বিশ্বব্যাপী যে সিনেমা বানানো হয় তার সব খানেই এই ধরনের দৃশ্যের অবতারণা করা হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবীণ পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এসব দৃশ্য গল্পে রাখার ক্ষেত্রে বা দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে সমাজের ওপর কেমন প্রভাব পরতে পারে সেটা কতটা চিন্তা করেন তারা?
তিনি বলছিলেন “আমরাতো অনেক আগের সিনেমাতে এটা দেখেছি যে নায়ক, নায়িকার পিছে পিছে ঘোরে। এটাতো ইভ টিজিং করে ঘোরে না। একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে অনেকে বছরের পর বছর ঘোরে , এটা তো হয়রানি না। যখন একটা সিনেমা বানানো হয় তখন আমরা পরিচালক এবং কাহিনীকার একসাথে বসে দৃশ্যটা সৃষ্টি করা হয়”।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন নায়ক যখন বিষয়টিকে যৌন হয়রানির পর্যায়ে দেখছেন না তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন – বাংলা চলচ্চিত্রে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনার এমন উপস্থাপনা কি সেগুলোকে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে?
বাংলা চলচ্চিত্রের বিশ্ব পরিবেশক এবং চলচ্চিত্র বিষয়ক সংবাদকর্মী সৈকত সালাউদ্দিন বলছিলেন এটার পেছনে অবশ্যই একটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে।
তিনি বলছিলেন “ধর্ষণ দৃশ্য এখানে যেটা দেখানো হয় সেটা বেশ প্রলম্বিত। আমি অনেক সিনেমার উদাহরণ দিতে পারি যেটাতে শুধু মাত্র চোখের একটা ব্যবহার আছে।
সব মিলিয়ে উপস্থাপন করা হয় বাণিজ্যিক উপকরণ হিসেবে। যতই যুক্তি দেয়া হোক এটা আসলে যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার জন্য এবং একটা শ্রেণীর দর্শকে আকর্ষণ করা। এর ফল যেটা হয়েছে, যুব সমাজের মাঝে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তারা সরলভাবে চিন্তা করে , একজন নায়ক যদি ইভ টিজ করতে পারে তাহলে আমি না কেন?”
পরিচালকরা যেমন বলেন গল্পের প্রয়োজনে এ ধরণের দৃশ্য রাখা দরকার হয়ে পড়ে, আবার চলচ্চিত্রের পরিবেশকরা বলেন ব্যবসায়িক কারণটাও মাথায় রাখতে হয় একজন লগ্নি-কারীকে অর্থাৎ সিনেমার প্রযোজককে।
তিনি বলছিলেন “আমরা যখন একটা সিনেমা নির্মাণের কথা বলি বা ইনভেস্ট করি বা নৃত্য পরিচালনা করি তখন এটা ভাবি যেন পরিবার নিয়ে সবাই দেখতে পারে। কিন্তু পরবর্তী যেসব এনজি শট থাকে সেগুলো লাগিয়ে হলে প্রদর্শন করা হয়”।
মি.বাবুলের বলছেন এনজি শট অর্থাৎ যে দৃশ্যগুলো প্রচারের জন্য না সেসব দৃশ্যের কথা। কিন্তু এনজি শট সেটা পরিচালক-প্রযোজকদের কাছেই থাকে , সেটা কিভাবে বাইরে হল পর্যন্ত পৌঁছায় সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এদিকে এই সিনেমার যারা দর্শক তারা কী মনে করছেন। আমি ঢাকার বলাকা সিনেমা হল এলাকায় কথা বলেছি কয়েকজন দর্শকের সাথে।
একজন নারী দর্শক বলছিলেন-“আইটেম সং নামে যেগুলো শুরু হয়েছে সেগুলোর কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না”।
আরেকজন পুরুষ দর্শক বলছিলেন-“রেপের দৃশ্য না থাকাই ভাল। কারণ এতে করে এক শ্রেণীর যুব সমাজ প্রভাবিত হয়ে পরে। আমরা যুব সমাজ, যেমন আমাদের মনে হয় নায়ক এটা করতে পারলে আমি করতে পারবো না কেন?”
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যমে খবর হতে দেখা যায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে ২০১৬ সালে ৬৫৯জন নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে।
২০১৭ সালে এই সংখ্যাটা বেড়েছে। ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। গত বছর চলন্ত বাসে এক তরুণীর ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
এছাড়া শিশুদের ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সন্তানের বাবা-মায়েরাও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
কিন্তু ধারাবাহিকভাবে এই সব ঘটনার মূলে মনস্তাত্ত্বিক যে বিষয়, সেখানে চলচ্চিত্র কতটা ভূমিকা রাখছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরিন যিনি সিনেমা নিয়ে গবেষণা করেন তিনি বলছিলেন সিনেমাতে ধর্ষণকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটা কাহিনীর প্রয়োজনে নয় বরং একটা পর্নোগ্রাফিক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
গীতি আরা নাসরিন বলছিলেন “আমরা অনেক সিনেমার ধর্ষণ দৃশ্য বিশ্লেষণ করেছি, যেটা দেখে মনে হয়নি যে এটা কাহিনীর প্রয়োজনে দরকার ছিল। ফরমুলা সিনেমাতে এটা যৌন উত্তেজক বিষয় হিসেবে দেখানো হয়। এখন মানুষ এটা বারবার দেখছে এবং একটা পর্যায়ে যেয়ে মনে করছে, এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। এটা তাদের মাথার মধ্যে গেঁথে যায় যে নারীর প্রতি এ ধরণের আচরণ করা যায়”।
সিনেমা বিশ্লেষকরা বলছেন সিনেমাতে ধর্ষণ দৃশ্য যেভাবে দেখানো হচ্ছে তাতে করে সমাজে এর এক বৈধতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সেন্সর বোর্ড বলছে তারা অশালীন কিছু থাকে এমন দৃশ্য কেটে তারপর ছাড়পত্র দেয়। আবার পরিচালক, প্রযোজক বা নায়ক নায়িকারা এটাকে গল্পের প্রয়োজন বলেই মনে করছেন।
কিন্তু সিনেমার দর্শকরা এটাকে কিভাবে নিচ্ছেন সেটাতেই অনেকখানি পরিষ্কার হচ্ছে যে সমাজে এর একটা স্পষ্টতই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সূত্র, বিবিসি